বগুড়া খ্রীষ্টান মিশন হাসপাতাল চিকিৎসা সেবায় সাফল্যগাঁথা এক নাম

যখন গোটা সমাজ কুসংস্কারের আঁধারে ঢেকে ছিল, চিকিৎসা বলতে বোঝাতো ঝাড়ফুঁক আর তাবিজ-কবচের নির্ভরতা, ঠিক তখনই এক টুকরো আশার আলো হয়ে আবির্ভূত হয় বগুড়া খ্রীষ্টান মিশন হাসপাতাল। শতবর্ষ আগের সেই সাহসী পদক্ষেপ ছিল আশার আলোয় ঘেরা এক দীপ্ত প্রদীপ। মানুষের নিঃশব্দ কষ্ট আর অবহেলায় ঢেকে থাকা অসুখ-বিসুখের অন্ধকার দূর করতে এক অনন্য নাম হয়ে ওঠে হাসপাতালটি। যার প্রতিটি ইট-পাথরে লেখা রয়েছে মানবিকতার গল্প, আত্মত্যাগের চিহ্ন আর সেবার মহিমা।
স্বল্প খরচে অবহেলিত ও স্বল্প আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে ১৯৪১ সালে চার্চেস অব গড মিশন চত্বরে প্রতিষ্ঠা করা হয় খ্রিস্টান মিশন হাসপাতাল। ব্রিটিশ আমলের শেষভাগে হাসপাতালটিকে নারী ও শিশু চিকিৎসার এক অনন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন ডাক্তার ও মিশনারি ইভা ফ্রেডালিয়া গিলবার্ট। তাঁর অসামান্য সেবায় হাসপাতালটি জনপ্রিয়তা পায় "গিলবার্টের হাসপাতাল" নামে। ডা. গিলবার্ট এদেশ থেকে চলে যাওয়ার পর আমেরিকার হোমবোর্ড এদেশের মিশন চালিয়ে নিতে ফিল্ড ডিরেক্টর পদ সৃষ্টি করে বাঙালি খ্রিস্টানদের ওপর এ বিশাল মিশনের দায়িত্ব অর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। নারীর মাতৃত্বকালীন সেবা, শিশুর টিকাদান ও ইনকিউবেটর সুবিধা, পুষ্টি পরামর্শ, সংক্রামক রোগের সাশ্রয়ী চিকিৎসাসহ লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে এই হাসপাতাল গড়ে তুলেছে চিকিৎসা সেবায় এক নীরব মহাকাব্য।
মিশন হাসপাতাল মানুষের দরজায় পৌঁছে দেয় আধুনিক চিকিৎসা সেবার এক নতুন দিগন্ত। মানুষকে নিবিড় সেবা দেওয়ার মাধ্যমে হাসপাতালটি চিকিৎসা ক্ষেত্রে এক আমূল পরিবর্তন এনেছে। শুরু হতে অদ্যাবধি সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেই নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবা দিয়ে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি। মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে সাধারণ ও জটিল রোগের চিকিৎসা, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, কম খরচে ওষুধ সরবরাহ সবই করছে মানবিকতার ভিত্তিতে। বিশেষ করে মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় খ্রীষ্টান মিশন হাসপাতালের অবদান প্রশংসনীয়। চক্ষু পরিক্ষা, নিরাপদ প্রসব, গর্ভকালীন পরামর্শ, শিশুর টিকা প্রদান, অপুষ্টি নির্ণয় ও চিকিৎসায় প্রতিষ্ঠানটির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। গ্রামের অনেক নারী এই হাসপাতালের সেবা গ্রহণ করে নিরাপদ মাতৃত্ব লাভ করেছেন। শুধু তাই নয়, হাসপাতালটি দীর্ঘদিন ধরে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে আসছে। ফলে, অস্বচ্ছল মানুষের জন্য এটি এক আশার আলো।
বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে হাসপাতালটিতে রয়েছে উন্নত আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা। রয়েছে অভিজ্ঞ চিকিৎসক, দক্ষ নার্স, সার্বক্ষণিক ল্যাব সুবিধা, অপারেশন থিয়েটার এবং ইনডোর-আউটডোর পরিষেবা।
বগুড়া চার্চেস অব গড মিশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ডোনাল্ড দাস বলেন, মিশন হাসপাতাল বগুড়ার মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় এক আস্থার নাম। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মানুষের পাশে থেকে নিরলসভাবে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি যুক্ত করেছি। পাশাপাশি, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে রোগীদের সর্বোচ্চ যত্ন ও সেবা নিশ্চিত করছি। আজও সমাজের পিছিয়ে পড়া, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এটি একটি নিরাপদ ও ভরসার স্থান। কেউ টাকার অভাবে যেন চিকিৎসা বঞ্চিত না হয় এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি। আমরা বিশ্বাস করি, চিকিৎসা শুধু একটি পেশা নয়, এটি একটি দায়িত্ব, এটি ঈশ্বরপ্রদত্ত সেবাকর্ম।
স্বাস্থ্যসেবার এই মহৎ অভিযাত্রায় মিশন হাসপাতালের পথচলা একটি আলোকবর্তিকা, যা কুসংস্কার দূর করে জাগিয়েছে বিজ্ঞানমনস্কতা, ফিরিয়েছে প্রাণ, দিয়েছে সুস্থতা। উন্নত চিকিৎসা, সুলভ ব্যয়, মানবিক আচরণ ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে এটি হয়ে উঠেছে চিকিৎসা সেবায় সাফল্য গাঁথা এক নাম।